ইমাম জাফর সাদেক (রহঃ) এর জীবনী, ইমাম জাফর সাদিকের জীবনী

 


ইমাম জাফর সাদেক রহঃ এর বংশ তালিকা

জাফর সাদেক (র)-এর কুনিয়াত আবু মুহাম্মদ। হযরত আলী (র)-এর সুযোগ্য বংশধর তিনি। অতএব সে হিসেবে রাসূলে করীম (স)-এর আহলে বাইয়াত তথা।পরিবার পরিজনের অন্তর্ভুক্ত। বলা হয়েছে, প্রসিদ্ধ বারো জন ইমামের মধ্যে তিনিও একজন। তিনি বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন। কুরআন ও ফিকাহ শাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিল । আর আমরা যাকে বলি এলমে মারেফাত-তাও ছিল তাঁর গভীর, সমকালের সেরা। এ বিষয়ে প্রচুর তত্ত্বপূর্ণ বাণী তিনি রেখে গেছেন। অর্থাৎ শরীয়ত ও মারেফাত-দু'দিক দিয়েই তিনি প্রজ্ঞাবান।

ইমাম জাফর সাদেক (র)-এর আধ্যাত্মিকতা

তখন মুসলিম দুনিয়ার খলিফা ছিলেন মনছুর বিল্লাহ। হিজরী শতকের প্রথমদিকে তিনি খলিফার কার্যভার গ্রহণ করেন। ইমাম জাফর সাদেক (র)-এর আলোকময় ব্যক্তিত্বের নাম- খ্যাতি, জনপ্রিয়তা, জনগণের ওপর তাঁর বিশাল প্রভাব, তাঁর প্রতি জনগণের অঢেল ভক্তি ও ভালোবাসা খলিফাকে চিন্তাতুর করে তুলল। হয়তো ঈর্ষা অথবা ভয়। কে জানে, হয়তো তিনিই একদিন খিলাফতের দাবি করে বসবেন। অথবা তাঁর ভক্তজনেরা মনসুর বিল্লাহ-এর তখতে ইমাম জাফরকেই বসিয়ে দেবেন। অতএব আগেভাগে সাবধান হওয়া দরকার। মনসুর বিল্লাহ একদিন তাঁর মন্ত্রীকে আদেশ দিলেন-জাফর সাদেককে বন্দী করে দরবারে আনা হোক। তিনি তাঁকে হত্যা করবেন।

বিভোর, খলিফা কিনা সে আত্মমগ্ন তাপসকে হত্যা করতে চান। তিনি সবিনয়ে খলিফাকে এমন কাজ করতে নিষেধ করেন। 

কিন্তু যাঁর হাতে জীবন, যাঁর হাতে মরণ, সে সার্বভৌম শক্তির অধিকারী আল্লাহর কী অপার মহিমা! জাফরকে দরবারে ঢুকতে দেখে খলিফার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। কী অপার্থিব আলোর জ্যোতি জাফরের চোখে-মুখে! আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ক্ষমতাভিমানী খলিফা। এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। তারপর জাফর সাদেককে সসম্মানে অভ্যর্থনা জানিয়ে সিংহাসনে এনে বসালেন। কি করতে চেয়েছিলেন, আর কি হয়ে গেল! মহামান্য খলিফা শুধু যে নিজের আসন ছেড়ে দিলেন তাই নয়, বসে পড়লেন মহাতাপসের পায়ের তলায়। কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। বললেন, বলুন, আপনার কি প্রয়োজন?
ইমাম জাফর সাদেক (র) উত্তর দিলেন, আমার কোন প্রয়োজন নেই। শুধু প্রার্থনা, ভবিষ্যতে এভাবে আমাকে ডেকে এনে আমার সাধনার বিঘ্ন ঘটাবেন না।।মনসুর কথা দিলেন। আর কখনো তা হবে না। তারপর তিনি তাঁকে সসম্মানে বিদায় দিলেন ইমাম জাফর সাদেক (র) যেমন এসেছিলেন, সেভাবে দরবার কক্ষ পরিত্যাগ করলেন। কিন্তু তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তির বৈদ্যুতিক প্রতিক্রিয়া তখনো শেষ হয়নি। বরং তা আরো সক্রিয় হলো। তিনি বিদায় নিতেই খলিফা অচৈতন্য হয়ে পড়লেন। আর খুব সহজে তিনি জ্ঞান ফিরে পেলেন না। অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে রইলেন দীর্ঘক্ষণ। পর পর তিন ওয়াক্ত নামাজ কাজা হয়ে গেল। আত্মীয়স্বজন ও সভাসদবর্গ হতবাক। কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল, কেউ বুঝতে পারলেন না। অবশেষে সংজ্ঞাশূন্য অবস্থাটা কেটে গেল। মনসুর চেতনা ফিরে পেলেন।

এবার তাঁকে সবাই ছেঁকে ধরলেন। এ কী অবস্থা কেন হয়েছে? কি হয়েছিল আপনার? মনুসর তখন সুস্থ, স্বাভাবিক। বললেন, যখন ইমাম জাফর সাদেক (র) দরবার কক্ষে প্রবেশ করলেন, তখন আমি দেখলাম তিনটি বিষধর সাপ ফণা বিস্তার করে আমাকে বলছে, দেখো মনসুর, জাফর সাদেকের কোন ক্ষতি করার যদি চেষ্টা করো, তাহলে আমরা তোমাকে দংশন করব। ঐ ভয়ঙ্কর সাপের ভয়েই আমি তাঁর সঙ্গে অমন সুন্দর ব্যবহার করে তাঁকে বিদায় দিলাম। কিন্তু মনের ভেতরে সে ভয় এখনো কাটেনি। তাই ওভাবে মূর্ছা যাই। আল্লাহ পথের যাঁরা পথিক, তাঁরা ধ্যানে মগ্ন, পৃথিবীর কোন শক্তি তাঁদের এতটুকু অনিষ্ট করতে পারে না। অপরিমেয় ঐশীশক্তি তাঁদের রক্ষা করে সর্বক্ষণ। মহাসাধকগণ সেই ঐশীশক্তির অধিকারী।

সমকালের আরো একজন বিখ্যাত সাধকের নাম হযরত দাউদ তায়ী (র)। একদিন তিনি এলেন ইমাম জাফর সাদেক (র)-এর কাছে। বললেন, হুযুর, মনে হয় আমার অন্তর মলিন হয়ে গিয়েছে। কিছু উপদেশ দিন। হযরত ইমাম জাফর সাদেক (র) বললেন, আপনি এ।কালের সর্বশেষ্ঠ তাপস। আপনার উপদেশের কি প্রয়োজন? দাউদ তায়ী (র) বললেন, হযরত! আপনি রাসূলুল্লাহ (স)-এর বংশধর। এ যুগের শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে আমাদের উপদেশ দেয়া আপনার কর্তব্য। তখন জাফর সাদেক (র) জবাব দিলেন, শেষ বিচারের দিনে নানাজী (রাসূলে করীম) যদি প্রশ্ন করেন, তুমি কেন আমার তাবেদারি করলে না, তখন আমি কি উত্তর দেব? সে ভয়েই আমি তটস্থ। মনে রাখবেন, বংশ দিয়ে কিছু হয় না। আমল বা সাধনা প্রয়োজন। আমলই মুক্তি আনে। এবার দাউদ তায়ী (র) কেঁদে ফেললেন। ওগো মাবুদ! যাঁর দেহে নবী করীম (স) এর রক্তপ্রবাহ, যাঁর স্বভাব-চরিত্রে নবী-চরিত্রের আদর্শ, যাঁর নানাজী প্রিয় রাসূল, যার জননী ধর্মনিষ্ঠ আদর্শ নারী-সেই তাপস-প্রধান জাফর সাদেকই যখন আপন কর্ম সম্বন্ধে হতাশ এবং মুক্তির বিষয়ে উৎকণ্ঠিত, তখন দাউদ তায়ী আর এমন কী মানুষ যে নিজের কর্ম সম্পর্কে গৌরববোধ করবে?

ইমাম জাফর সাদেক (র)-এর কয়েকটি ঘটনা

  • ১. একবার হযরত ইমাম জাফর সাদেক (র) বেশ দামী পোশাক পরে আছেন। তা দেখে একটি লোক প্রতিবাদের সুরে বললেন, হুযুর, আপনি নবী-বংশের লোক। আপনার পক্ষে এমন পোশাক পরিধান করা শোভনীয় নয়। ইমাম জাফর সাদেক (র) তাঁর হাতখানি টেনে জামার ভেতরে ঢুকিয়ে দেখালেন ভেতরের জামাটি পুরু আর খসখসে। বললেন, আমার একটি জামা আটপৌরে, মানুষের মাঝে চলাফেরার জন্য। আর অন্যটি হল আল্লাহর দরবারে নামায আদায়ের জন্য।
  • ২. একবার দু মহাজ্ঞানীর মিলন হল। ইমাম জাফর সাদেক (র) ও ইমাম আবু হানিফ (র)। জাফর সাদেক (র) আবু হানিফা (র)-কে জিজ্ঞেস করলেন, জ্ঞানী কাকে বলে? জ্ঞানীর সংজ্ঞা কি? ইমাম আবু হানিফা (র)-এর উত্তর, জ্ঞানী সে ব্যক্তি, যিনি ভাল ও মন্দের বিচার জানেন। জাফর সাদেক (র) বললেন, একটি জন্তুও তা জানতে পারে। কেননা, যে তাকে আদর- যত্ন করেন সে তার ক্ষতি করে না। অপর দিকে, যে তার যত্ন-আত্তি করে না, বরং কষ্ট দেয়, সে তার ক্ষতি করে। ইমাম আবু হানিফা (র) বললেন, তাহলে এবার আপনি জ্ঞানীর সংজ্ঞা বলুন, জাফর সাদেক (র) তখন বললেন, জ্ঞানী সেই ব্যক্তি, যিনি দু'টি ভালো কাজের মধ্যে বেশি ভালটিকে গ্রহণ করেন। আর দু'টি খারাপ কাজের মধ্যে কম খারাপটিকে গ্রহণ করেন।
  • ৩. একদিন একটি লোক ইমাম জাফর সাদেক (র)-কে বললেন, আপনার মধ্যে বাহা ও গুপ্ত উভয় গুণই আছে। কিন্তু বহুক্ষেত্রে দেখা যায়, আপনি যেন নিজেকে কিছুটা বড় মনে করেন। সাধক ইমাম জাফর সাদেক (র) বললেন, আমার যা কিছু নিজস্ব, গৌরব বা গর্ব সব কিছু আমি মুছে ফেলেছি। তবে কিছু কিছু আল্লাহ্ প্রদত্ত গৌরব থাকে যা আপনা থেকে প্রতিভাত হয়। সেখানে মানুষের কোন হাত নেই। সুতরাং তাকে অহঙ্কার বা অহমিকা বলা চলে না।
  • ৪. হযরত ইমাম জাফর সাদেক (র) তাঁর সহচর বন্ধুদের বললেন, এস, আমরা আজ সকলে শপথ নিই, রোজ কিয়ামতে আমাদের মধ্যে যে মুক্তিলাভ করবে, সে আর সকলের গুনাহ মাফীর জন্য আল্লাহ্ পাকের দরবারে সুপারিশ করবে। তারা বলল, হুযুর, যেখানে সুপারিশ করার জন্য স্বয়ং আপনার নানাজী উপস্থিত থাকবেন, সেখানে আমাদের এমন শপথের কি কোন প্রয়োজন আছে? জাফর সাদেক (র) বললেন, শোন, আমার নিজের ব্যাপারে ঐদিন তাঁর দিকে তাকাতে আমার লজ্জা লাগবে। তাই তোমাদের এমন প্রস্তাব দিয়েছি এ ধরনের প্রচুর ঘটনা হযরত ইমাম জাফর সাদেক (র)-এর জীবনে আছে। প্রতিটি ঘটনাই চমকপ্রদ, আলোকিত। আত্মনিবেদিত একটি মানুষের এ কাহিনী আমাদেরও আঁধার- হৃদয়ে আলো এনে দেয়।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post